চলো মুজাহিদ

সহীহ্ বোধদয়ের স্বার্থে দায়িত্ব মনে করলে অনুগ্রহপূর্বক শেয়ার করুন:

আমিন ইবনে আব্বাস

   কাবুল শহরের একটি বাড়ী। নিজাম আর নঈমের বড় ভাই সাঈদ বসে হোম ওয়ার্ক করছিল ড্রইংরুমে। দুজনেই বিশ্ববিদ্যালয়ের এম, এস, সি অংকের ছাত্র। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে নিজাম তাই হোষ্টেল ছেড়ে ওদের বাসায় আসে জটিল অংকের সমাধান করার জন্য। আজকেও দু’বন্ধুই বসে অংক কসছিল।

সেখানে ঝড়ের বেগে হাপাতে হাপাতে ঢুকল নঈম।

-নিজাম ভাই ওরা তোমায় খুঁজছে! কথাটা নঈমের মুখে শুনে চমকে ওঠে নিজাম

-খুঁজছে মানে! আর তারা কারা? বিব্রত স্বরে জানতে চায় নিজাম

-পুলিশের লোক! জবাব দেয় নঈম।

   তড়িতাহত হয় নিজাম। কথা বলতে পারে না। অন্ততঃ পুলিশ খুঁজে বেড়াতে পারে এমন কোন কাজের সাথে নিজামের বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভাল নয়। সামরিক অভুথানে ক্ষমতায় এসেছে সরকার। বামপন্থি বিপ্লবী সরকার দেশের বিধাতা এখন। প্রতি দিনে তাই চলছে শুদ্ধির নামে মুজাহিদদের নিশ্চিহ্ন করার অভিযান। কিন্তু নিজামতো নঈম, সাঈদদের মতো ইসলামী পুন:র্জাগরণে সক্রীয় নয়। তবে তাদের সমর্থক বলা যায়।

   নঈমকে দীর্ঘদিন থেকে এবং ভালভাবেই জানে নিজাম। ইসলামের জন্য এ বয়সে নিজেকে অধ্যবসায়ের সাথে গড়ে তুলে ইসলামের জন্যই উৎসর্গকৃত হবার অনন্য উদহারণ নঈম। মাঝে মাঝে অত্যন্ত অবাক হয়েছে নিজাম এ যুবকের আত্মপ্রতয়ে। টকটকা চেহারার চাপ দাড়িতে চোখ রেখে তাই প্রশ্ন করেছিল নিজাম, কিছুটা ভিন্নার্থে

-এ বয়সেই তুমি দরবেশ হয়ে যাচ্ছ নঈম

-তা নয় নিজাম ভাই। আমি যে আল্লাহর গোলাম তার স্বাক্ষর আমায় প্রতি মুহূর্তেই বহন করে চলতে হয়। নামাজে পাঁচ বার হাজিরা দিয়ে আমি সে কথাই বার বার বলে আসি যে, সারাদিনে, সারাজীবনে আমি যা করব, যা খাব, যা বলব সবটাতেই মূর্ত হয়ে উঠবে আল্লাহর প্রতি আমার গোলামী। এটা কোন অতিরিক্ত তো নয়।

   মন্ত্রমুগ্ধের মত কথা গুলো হজম করে নিজাম। নিজাম জানে এ অভ্যত্থান নঈমের বাঞ্চিতের পুরো বিপরীত। এর জন্য নঈমকে সামলাতে হবে অনেক বাধার পাহাড়।

   নিজেকে বর্তমানে নিয়ে এসে বলে নিজাম

-তুমি কি ঠিক বলছ নঈম? কিন্তু কি আমার অপরাধ?

-নিজে খোঁজ নিয়ে জেনেছি আমি, পুলিশ তোমায় খুঁজছে। তাছাড়া তুমি কেন ভূলে যাচ্ছে যে আজ ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের ধ্বংস করার নীল নকসা আঁকা হয়েছে। এ প্রয়োজনে তারা গাছ উপড়ে ফেলতে বদ্ধ পরিকর, এমনকি শিকড়ের শাখার বর্ধিষ্ণু অঞ্চল পর্যন্ত। তাই একজন সমর্থক হিসেবে তুমিও কি নিরাপদ? না, আমার তা মনে হয় না।

   সাঈদ তাকিয়ে শুনছিল ছোট ভাইয়ের কথা। এবারে যোগ দেয় সে

-আর সে সুর ধরেই বলতে হবে, তুমি এমন এক ব্যক্তির জামাতা যার গোটা পরিবার জীবনের শেষ ক্ষনটি পর্যন্ত ইসলামের জন্য উৎসর্গীকৃত প্রাণ।

একটু থেমে  আবার শুরু করে সাঈদ

-জান, এরা দ্বীনের কোন চিহ্ন রাখতে চায় না। কিন্তু আমরা তা হতে দেব না ইনশাল্লাহ। এ লক্ষেই শাহাদতের আলিঙ্গনে দেহ থেকে রক্তের যে ফিনকি ছুটবে, তারই তীব্ৰধারা সরাসরি কুফরী শক্তির বক্ষ ভেদ করে আল্লাহর আরশে গিয়ে পৌঁছুবে। শরীরের প্রতিটি রক্ত কনিকা আজ তাই নির্দেশের অপেক্ষায় সদাপ্রস্তুত।

      শুনতে শুনতে চোখ জ্বলে ওঠে নঈমের, বুকের ছাতি ফুলে ওঠে। কোন উদ্বেগের লেশমাত্র নেই। অসম্ভৰ কঠিন একটা আত্মবিশ্বাস ও গৌরব যেন ছড়িয়ে আছে সমস্ত শরীর জুড়ে। গত কয়েকদিন আগে মিশরের এক ধর্মীয় নেতার মৃত্যুদণ্ডের কথা মনে হয় নিজামের। অপরাধহীন নিস্পাপ এ মানুষটিকে কত ভালবাসত নিজাম আর তাকে জান দিয়ে ভালবাসত নঈম।

কাছে এগিয়ে আসে নঈম। তার গলায় যেন অনুভূতি জেগে ওঠে বিরল আন্তরিকতার

-নিজাম ভাই আমাদের বাঁচতে হবে। অন্ততঃ আগামী দিনের প্রতিরোধের জন্য। এক সময় দেখবে ইসলামের ডাকে বাধভাঙ্গা জোয়ার উঠবে মাদ্রাসা, কলেজ, বিদ্যালয় থেকে। তার সাথে যুক্ত হতে থাকবে কাতারের পর কাতার মুসলিম জনতা। আর তার ঝাপটাতেই সাম্যবাদীদের অস্তিত্বে পড়বে মরন আঘাত, সে আঘাত আমরা হানবোই।

      ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায় নঈম ক্ষনিকের জন্য। ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ে নিজাম। মনে পড়ে সায়রার কথা। তাহলে ওরা এখন কোন অবস্থায় আছে? পুলিশ কি সেখানেও হানা দিয়েছে?  তারা কি টিকে আছে যেখানে তাকে পুলিশ ধাওয়া করছে।

     পরীক্ষার তিনদিন পূর্বে মাত্র একদিনের জরুরী কলে বাড়ি গিয়েছিল নিজাম। বিয়ে! তার নিজের। তখন বিয়ের ইচ্ছা না থাকলেও সবটা শুনে না করতে পারেনি নিজাম। এ প্রস্তাবটা বেশ আগে থেকেই চলে আসছিল। কোনদিন দেখেনি নিজাম সায়রাকে। কিন্তু বাসর রাতে একনজর দেখেই বিদ্ধ হয়েছিল সে। চুম্বকের আকর্ষনে তাই সাড়া দিয়েছিল সেক্ষনেই। ভালবেসে ফেলেছিল ওরা পরস্পরকে। ছেড়ে আসতে মন একটুও সাড়া দেয়নি। কিন্তু পরীক্ষার কারণে পর দিন যখন বিদায়ের পালা, তখন সায়রার অশ্রু টলমল চোখ দেখে অস্থির হয়ে উঠেছিল সে। বলেছিল

-কেঁদোনা সায়রা দোহাই তোমার। এখন কাঁদবার সময় নয়। এখনত আমি তোমারই আছি তোমারই থাকব আমৃত্যু। কই এবারে কথা বল। শুধু বলেছিল সায়রা

-পর পর চিঠি দিও, তা না হলে এসে দেখবে আমি হারিয়ে গেছি অতল তলে।

-ছিঃ একথা বল না। দেখবে পরীক্ষা শেষ করেই ট্রেন ধরেছি। কই তোমার প্রেমিকের নিকট থেকে তোমার জন্য প্রথম উপহার কি হবে তাতো বললে না।

    বলে নাই সায়রা। চুপ করে ছিল। আবার জানতে চেয়েছিল নিজাম। এবারে বলেছিল সায়রা

-আমার প্রাপ্তীর বুভূক্ষ মন তো তোমার মাঝেই বিলীন হয়ে গেছে। তোমার পাবার পর এখন সব প্রয়োজন মিটে গেছে। তুমি ফিরে এলে তোমাকে কাছে পাওয়াটাই সব থেকে বড় উপহার

   আবেগে আতিশয্যে এরপর বুকে তুলে নিয়েছিল নিজাম স্ত্রীকে। আরও কাছে টেনেছিল। বলেছিল

-তাতো সত্যি সায়রা। কিন্তু এরপরও তোমাকে এমন একটা উপহার দেব যা পেলে তুমি খুব খুশী হবে

-বেশ দিও। সাড়া দিয়েছিল সায়রা। তারপর আরো বলেছিল সায়রা

-কিন্তু তোমায় দেবার মত আমার যে আর কিছুই বাকি নেই।

   স্মৃতি রোমন্থনে ছেদ পড়ে নিজামের। আবার হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে নঈম।

-নিজাম ভাই পুলিশ বাড়ী ঘিরে ফেলেছে। ওরা কিন্তু তোমার খোঁজে এসেছে।

    কি ভেবে ঠোট-মুখ ঘৃনায় কুচকে যায় নঈমের-যেন কিছু চিবিয়ে খাবে। বলে

-কিন্তু নিজাম ভাই তুমি যে এ বাড়ীর অতিথি। ভাইয়ার বন্ধু। তোমার হেফাজতের দায়িত্ব আজ এ বাড়ীর উপর। এ ছাড়াও তোমার আগমন পথে চোখ রেখে প্রতিদিন প্রহর গুণছে সেই এক বিশেষজন।

একটু দম নিয়ে বলে নঈম

-বরং পথিবীতে আমার বন্ধন নেই। এ বাড়ীর অতিথির মর্যাদা তাই আমিই রাখব। শেষের কথাগুলো স্পষ্ট হয় না। ক্ষীণ প্রতিবাদ করে নিজাম।

-এ হয় না নঈম, এটা হতে পারে না।

   ততক্ষণে পর্দার ওপারে ক্রমান্বয়ে ভারী বুটের আওয়াজ অধিক হতে থাকে। পরমুহূর্তেই ঘরে ঢোকার পর কর্কশ কণ্ঠ ছুটে আসে রিভলভাবধারীর গলা জুড়ে

-এখানে নিজাম উদ্দীন কে? সাড়া দিন?

   খানিকটা সামনে এগিয়ে যায় নঈম

-আমি! বলুন আপনারা কি চান?

-আপনাকে আমরা এরেষ্ট করছি। চলুন আমাদের সাথে।

    স্থীর নিশ্চল হয়ে দাড়িয়ে আছে নিজাম। নঈমের প্রথম মুখ খোলার সাথেই নিজামের বুকের রক্ত একবার লাফ দিয়ে নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছে। তাগিদ দেয় পুলিশ অফিসার

-কই চলুন। তাকায় নিজাম নঈমের দিকে। নঈমকে বাধা দেবার কিম্বা না দেবার কোন শক্তিই যেন নেই তার।

   ঘুরে দাড়ায় নঈম। আর পরক্ষনেই ঝাপিয়ে পড়ে রিভলবারীর উপর। পর মুহুর্তেই ধস্তাধস্তির মাঝে গর্জে ওঠে বিভলভার। বুলেট ছোড়ার শব্দে চমক ভাঙে নিজামের। লুটিয়ে পড়েছে নঈম মেঝের উপর। গল গল বেগে রক্ত বেরিয়ে আসছে নঈমের শরীর ভেঙে। মূহুর্তেই বাহির থেকে ছুটে আসে আরো পুলিশ। ক্রমান্নয়ে নিস্তেজ হয়ে আসছে নঈমের দেহ। ঘেমে উঠেছে নিজাম। রাগে ফুলছে পুলিশ অফিসার। পিস্তলের বাট দিয়ে আঘাত করতেই নঈমের দেহটা চিরতরে নিস্তেজ হয়ে যায়। তারপর ওরা ছেচড়াতে ছেচড়াতে নঈমকে নিয়ে যায় বাইরে। রক্ত কণিকাগুলো তখনও যেন আনন্দে ছুটাছুটি করছে। যেন এগিয়ে যাচ্ছে ওরা নিজামের দিকে। তা দেখে শরীরটা যেন কেঁপে কেঁপে উঠছে নিজামের। রক্ত কনিকারা তার কাছে এসে যেন বলছে ‘নিজাম ভাই আমাদের বাঁচতে হবে। অন্ততঃ আগামী দিনের প্রতিরোধের জন্য। এক সময় দেখবে ইসলামের ডাকে বাধভাঙ্গা জোয়ার উঠবে মাদ্রাসা, কলেজ, বিদ্যালয় থেকে। তার সাথে যুক্ত হতে থাকবে কাতারের পর কাতার মুসলিম জনতা। আর তার ঝাপটাতেই সাম্যবাদীদের অস্তিত্বে পড়বে মরন আঘাত, সে আঘাত আমরা হানবোই।

   ঘরের উল্টো দিকের দরজাট তীব্র শব্দে খুলে গেলো। দীর্ঘদিন বিছানায় শায়িত্ব নাঈমের পিতা টলতে টলতে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়েন রক্ত প্লাবিত পুত্রের উপর, ছেলেকে জড়িয়ে ধরবেন পরম স্নেহে। রুক্ত কনিকাগুলো লাফিয়ে ওঠে বৃদ্ধের বুকে। চুমো দেয় বৃদ্ধ ছেলের বুকের কাপড়ে, গলায়।

  অসহায় স্বগোক্তি করেন বৃদ্ধ

-নিয়ে গেল, আমার ছেলেকে ওরা নিয়ে গেল। আমি যে ওর ছাত্র ছিলাম। এ বয়সে ইসলামের প্রতি ওর উৎসবের ফোয়ারা দেখে আমি যে আবার যৌবনে ফিরে যাবার স্বপ্ন দেখতাম।

    করাঘাত করেন বৃদ্ধ মেঝের উপর

-জান বাবা, আমি ওর মাঝে দেখছিলাম অনাগত সম্ভাবনা। অনেকেই ওর মাঝে তারিক ও মুহাম্মাদ বিন কাশিমকে উকি মারতে দেখেছে। ওরে নঈম! বাবা আমার।

    হু হু করে কঁদতে থাকেন বৃদ্ধ, গোটা শরীরের কাপড় ততক্ষনে রক্তে লাল হয়ে উঠেছে।

-তুইতো চলে গেলি কিন্তু তোর বাবাকে কেন এ অসহায় অবস্থায় ফলে গেলি বাবা? নিজে এতটাই অচল যে, তোর রেখে যাওয়া কাজকে আমিতো সামনে এগিয়ে নিতে পারব না। আরও বিগলিত ধারায় অশ্রু ঝরতে থাকে নঈমের বাবার চোখ থেকে। এবারে চিৎকার করে ওঠেন তিনি

-না, বিশ্বাস করি না ও নেই। ওরা শুধু ওর দেহটাকে স্তব্ধ করে দিয়েছে কিন্তু ওর সুন্দর মনটাকে তো ওরা মারতে পারেনি। আর স্থির থাকতে পারেনা নিজাম। তখনও কানে বাজছে নঈমের সেই কথা।

-আগামী দিনের জন্য আমরা বাঁচব, বাঁচতে আমাদের হবেই।

আবেগ কম্পিত কন্ঠে বৃদ্ধের পানে চায় নিজাম

-চাচা, আমার মাঝেই তোমার নঈম জীবন্ত হয়ে থাকবে। ওর মনটা যে খুবই উর্ধে, মহত্বের শীর্ষে। তাইতো বিদায়ের সময় অকৃপনভাবে ওর মনটা আমায় দিয়ে গেল। আরো বলে গেল, আগামী দিনের জন্য আমার মাঝে ওর বেঁচে থাকা খুবই প্রয়োজন। মুহুর্তেই উজ্জ্বল হয়ে ওঠে বৃদ্ধের মুখমণ্ডল। শরীরে যেন শক্তির উচ্ছাস দেখা যায়। আবেগে বলে ওঠেন তিনি

-পারবে, পারবে তুমি নিজাম?

–পারব, পারব ইন শা আল্লাহ। যেন আত্ব-বিশ্বাসে নিজামের বুকটা আরও প্রসস্ত হয়ে ওঠে।

   নঈমের বাবার কোলে ভেঙ্গে পড়ে নিজাম। হারিয়ে যায় বৃদ্ধের অশ্রুর বিষাদ সিন্ধুর মাঝে।

-চাচা আজ শুরু হলো আমার জীবনে পরিবর্তনের ডংকা বাজানোর মহরত। এখন থেকে আমি হবো আর এক নঈম।

   এরপর নঈমের বাবাকে দু’হাতে ধরে আস্তে আস্তে তুলে দাড় করায় সে। তারপর বলে

-তুমি আমায় দোয়া করে দাও চাচা, ঠিক যেমন করেছিলে নঈমকে

   হাত ওঠান বৃদ্ধ

-করব। নিশ্চয়ই তোদের জন্য দু’হাত তুলে থাকব। খোদা এ জীবনে নঈমদের, নিজামদের সহ হাজার হাজার নওজোয়ানের হাতে তৌহিদের বিজয় পতাকা আমার প্রিয় মাতৃভূমিতে দেখতে চাই আমি। সে বিজয়ের গোটা পথে তোমার সাহায্য ওদের আজ বড় প্রয়োজন।