দ্বিতীয়বার নয়

সহীহ্ বোধদয়ের স্বার্থে দায়িত্ব মনে করলে অনুগ্রহপূর্বক শেয়ার করুন:

আমিন ইবনে আব্বাস

এখানে আসা অবধি জানালাটাই স্বস্তি দিয়েছিল নীলাকে। বসেছিল নীলা বাইরের দিকে দৃষ্টি মেলে। না! ওরা এখনও ফেরেনি। আবহাওয়া ভাল হবার কোনই লক্ষন দেখা যাচ্ছে না। ইদানিং ঐ গাছের পরিচিত ডালটা বার বার প্রচন্ড ভাবে বাতাসকে মোকাবেলা করার চেষ্টা করে চলেছে। প্রচন্ড ভাবে দুলে উঠছে বার বার।

কিন্তু গেল কোথায় ওরা? এখনও ফিরছে না কেন? এমন দুরন্ত আবহাওয়া দেখেও ওদের বাড়ী ফেরার কথা মনে আসছে না কেন?  প্রশ্ন আসে নীলার মনে। তা ছাড়া বাতাস যা খেপেছে তাতে ঐ পাখির বাসা মাটিতে না নামিয়ে ছাড়বে না। ইতিমধ্যেই বাসা থেকে দু’একটা পালকও বাতাসের হুকুমে লুটিয়ে পড়ল নীচে। তাহলে কি করছে বুলবুলি যুগল এখন?

নিশ্চয়ই ওরা হারিয়ে গেছে একে অপরের মাঝে ঠিক যেমন করে সে আর সৌরভ হারিয়ে যেত কুশুম পাহাড়ের ছায়া ঘেরা পাদদেশে। একি! সৌরভের সাথে অভিসারের তুলনা। একি ভাবছে সে। এখন সৌরভ তার কে? নাটকের শেষ দৃশ্যের পর্দা এইতো দু’দিন আগে পড়েছে।

দিন দুই আগের সে রাতে আহসান তাকে সবার সামনে সাক্ষী-উকিল খাড়া করে নিজ ভাগে এনে ফেলেছে। আজ তাই সৌরভের ভাবনা পাপ।

এতকিছু বোঝার পরও নীলার ভিতরের মানুষটা স্মৃতি হয়ে ঘন ঘন উকি মারে, ছায়া ছায়া ভীড় জমায়। সে ভীড় ঠেলে সে কিছুতেই বাইরে আসতে পারছে না গত ক’দিন।

পাশাপাশি বসে ছিল ওরা দু’জন। নীলা আর সৌরভ। পাশের ঝোপের সারিটা সে সময় ওদেরকে সবার দৃষ্টি থেকে আড়াল করে রেখেছিল। ঘন সবুজের সে মায়াবী সমারোহ যেন আরো হারিয়ে যেতে ইন্ধন যোগাচ্ছিল। আপন স্বত্তাকে ভুলে গিয়েছিল ওরা দু’জনেই। মনে হয়েছিল প্রকৃতি যেন আদম-হাওয়ার মত ভালবেসে তাদের দু’জনকে কোলে টেনে নিয়েছে। যেন আকুল আবেদন জানাচ্ছে ধরে রাখবে। আর নীলাও ভাবছিল ‘ধরা দেবে’।

ভালবাসার সুবাশ ছড়িয়ে নীলা বলেছিল

-দেশ আমার, মাটি আমার। এরপর থেমে গিয়ে তাকিয়েছিল সৌরভের দিকে, যেন বাকিটা জুড়ে দেবে সৌরভ। সৌরভও পিছিয়ে থাকেনি।  সাড়া দায়েছিল

-তুমিও আমার। কিন্তু ছেদ পড়ে গেল ভাবালুতার। বুঝতে পারে সৌরভ সুর কেটে গেছে। ভাবের জগতে তাল মিলাতে সে কমই পারে। বিব্রত বোধ করে সৌরভ। নীলার দৃষ্টাটা যেন তাকে চষে বেড়াচ্ছে।

এমন সময় কানে এল নীলার

-আপা, চা এনেছি। একটা ছোট্ট শব্দ করে ট্রেটা নামিয়ে রাখে ছোট্ট কাজের মেয়েটি। নীলাকে সাহায্য করার জন্য মা এ মেয়েটিকে সাথে দিয়েছেন। সে বিয়ের রাতেই। ট্রের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারে নীলা আহসান অফিস থেকে ফিরেছে। এতক্ষনে খেয়াল করল নীলা, ঘরের বইগুলো সুন্দর করে সাজান। কিন্তু কে এত যত্ন করে সাজাল? স্যান্ডেলগুলোও আর অপাংতেয় ছড়িয়ে ছিটিয়ে নেই। একি! কাপড়গুলোও গোছানো।

-আশ্চর্য! স্বগোক্তি করে নীলা

তারপর আপন মনে বলেও ওঠে নীলা

-‘সত্যিই ব্যতিক্রম’। তার মানে হচ্ছে, বেশ আগেই অফিস থেকে ফিরেছে আহসান। নি:শব্দে বাসায় ঢুকেছে, কাপড় ছেড়েছে। কাজ করেছে। অথচ সে কিছুই টের পায়নি। ইচ্ছে করেই সে নীলাকে ডিসটার্ব করেনি।  এমনকি চা পাঠাতেও ভোলেনি।

অবশ্যই ব্যতিক্রম। মনে পড়ছে, নির্লজ্জের মত সৌরভ তার বিদেশী কাজিনকে বিয়ের নিমন্ত্রন পত্র এমনকি তার বাবার কাছেও পাঠিয়েছিল। ছুটে এসে ছোট বোন মিনাই জানাল

– আপা শুনেছ, সৌরভ ভাই বিয়ে করছেন।

-‘কি’ প্রচন্ড একটা ধাক্কা খেয়েছিল নীলা। সৌরভ বিয়ে করছে অথচ কনে তা জানেনা। কষে একটা তাপ্পড় মারল সে মিনাকে। ঝট করে মিনার হাত থেকে কার্ডটা ছিনিয়ে নিল এক রকম। তাতে লেখা

-‘আহম্মদ সাব্বিরের পুত্র আহম্মদ জামিল ওরফে সৌরভের সাথে লন্ডন নিবাসী … … আর পড়তে পারে না নীলা। জাপটে ধরে বোন মিনাকে। এর পরেক্ষনেই মিনাকে ছেড়ে দিয়ে ছুটে গিয়ে লুটিয়ে পড়ে নিজ বিছানার উপর । অঝোরে কাঁদছে নীলা। বিছানাটা বুঝিবা বন্যায় ভেসে যাবে। সেদিন সৌরভ পশু হয়ে গিয়েছিল। তা না হলে কি করে থরে থরে ফুল-পাতায় সাজের বরের গাড়ীটি তাদের বাসার সামনা দিয়ে যেতে পারল। সৌরভের নতুন গাড়ী হল, ব্যবসা আরো বড় হল। লন্ডনে উড়াল দেবার জন্য পাখার ব্যবস্থা হল। তার মানবিকতার পরিবর্তন হলো এমন এক ভূখন্ডের রঙ্গে-যেখানে যাবার জন্য তার সব প্রস্তুতি এই শেষ হলো বলে। পরে শুনেছে নীলা, পাত্রী নাকি ভুবন বিজয়ীনি সুন্দরী। যেখানেই সে যায়, জয় না করে ফেরে না। তার ফাঁদ নাকি কোন যুবক এড়াতে পারে না। কে জানে সৌরভের জন্যও ফাঁদটা কেমন হবে? কিন্তু সে খবরে এখন আর নীলার কিছু আসে যায় না।

শুধু সৌরভ নয়, নীলারও পরিবর্তন হল। নাহ্, নীলা কাঁদবে না। কিন্তু তা বেশীদিন তা ধরে রাখতে পারল না। মনের অজান্তে নিজেকে গুটিয়ে ফেলল সে, যেন চঞ্চলতায় চন্দ্রিমা আলো করা মেয়েটি তার আলোর সবটা হারিয়ে ফেলেছে। আগের সেই রান্নার কাজ, সেলাইয়ের কাজ, রুম সাজানোর কাজ অবহেলায় পড়ে স্বেচ্ছা নির্বাসন নিল। ছুটির দিন বাবার উপস্থিতিটা সব সময় সাড়া জাগানো। ছোটদের নিয়ে গল্প বলা, শব্জী বাগানে কাজ করাটা ছিল রুটিন। আবার রান্নাঘরে একটা তরকারী রান্না করতে গিয়ে আম্মুর সাথে মসলা আর রান্না ষ্টেপের টাইমিং নিয়ে বিতর্ক সবার নযরে পড়ার মতো। নীলা না চাইলেও বাবা তার চুল বেঁধে দেবেন-যা থেকে রেহাই ছিল না নীলার। কখনও নীলা এড়াতে চাইলে দীর্ঘদিনের অভ্যাস জারি রাখতে অন্তত: একবার হলেও তার মাথায় চিরুনি চালাবেন বাবা। আম্মা চাইতেন না বাবা কিচেনে ঢুকুক, কিন্তু আব্বা নাছোড় বান্দা। সন্তানরা কিন্তু আব্বার রান্নাটা মজা করেই খেত।

কই আজতো কোথাও বাবার সাড়া নেই। আজ রোববার দুপুরের সময় রান্না ঘরের বিতর্ক নেই। বহুদিনের এ এক রুটিন ভঙ্গ। কি যে হল নীলার, বাবার ঘরের দিকে হাটা দিল সে। এক রকম ধাক্কা দিয়েই দরজাটা ঠেলে ভিতরে ঢুকে পড়ল। কিন্তু একি চেহারা হয়েছে বাবার। চমকে ওঠে নীলা। বাবার চোখে দিকে তাকান যায় না। গত তিন-চার  দিনের মধ্যে যে বাবার বয়স বিশ বছর বুড়িয়ে গেছে। বাবাকে চেনাই যাচ্ছে না। এ ক’দিনতো সে নিজেও বাবার খোঁজ নেয়নি। সে তো নিজেকে নিয়েই আত্মগোপনে ছিল।

মার কথা মনে আছে নীলার। মার কাছেই এ সব শোনা। প্রথম সন্তান হয়ে নীলা এল পরিবারে । এরপর বাবার সে কি আয়োজন। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন সবাইকে ডাকলেন বাবা। নাম রাখা নিয়ে সে এক এলাহী কান্ড, আর দরদীদের মুখোমুখি। অবস্থাটা যেন বাবার চেয়ে ওদেরই নাম চয়ন করার বেশী দায়। নিজের ব্যবসার দপ্তরে গিয়ে বাবা ঘন ঘন ফোন করে মেয়ের খবর নেন।

-কইগো, নীলা কি ঘুমিয়েছে?

-হ্যা, এই মাত্র। তুমি যাবার পর কাঁদছিল।

-কাঁদবেইতো। অতটুকু হলেও বোঝে বাবা চলে যাচ্ছে বাইরে

মা-বাবা এক সাথে হেঁসে ওঠেন। ঘন্টা দু’য়েক পরে আবার ফোন।

-রেবা মেয়ে আমাদের কি করছে?

-ঘুমাচ্ছে

-এখনও ঘুম থেকে ওঠেনি?

-না, উঠছে না।

-না, না। এটা ঠিক নয়। নিশ্চয় ক্ষুধা পেয়েছে। জানত বাচ্চাদের অল্প অল্প করে বার বার খেতে দিতে হয়। ভাবটা এমন যেন মা তা জানেন না।

স্ত্রী অনুযোগ করে

-আমাকে এখন বাচ্চার কাপড় আর আমাদের কাপড় নিয়ে বাথরুমে ঢুকতে হবে। বাবা কথা বন্দ করেন। তবে একটু পরেই বলেন

-ঠিক আছে। তাকে খাইয়ে তবে আমাকে ফোন কর।

ক্রিং ক্রিং। আবার বাবার ফোন আসে

-মা-মনির কি গোসল হয়েছে? কোন জামাটা পরিয়েছ। না না, গোলাপি আজ থাক। হলুদটাই পরাও।

অফিস শেষ করার পাঁচ মিনিট আগে আবার ফোন

-আজ নীলার জন্য কি কি আনতে হবে বলে দাওতো?

মাস দুয়েক পরে বার বার ফোন ধরতে গিয়ে মা নিজেই বিরক্ত হয়ে পড়লেও বাবাকে তা বুঝতে দিতেন না। কষ্ট করে নিজে হজম করতেন। মা জানতেন তিনি যদি অসহযোগীতা করেন তাহলে তা বাবাকে কতটা আহত করবে। তারপরও একদিন দুপুরের পর আবার ফোন আসায় মা অসতর্ক বলে ফেলেন

-দেখ! বাসায় কি কাজ কম? আমি তোমার ফোন ধরতে ধরতে নাজেহাল। হয় তুমি তোমার অফিস বাসায় আন নয়ত আমাদের দু’জনকে দিনমান অফিসে রাখার ব্যবস্থা কর।

-তারপর, তারপর বাবা কি করলেন? আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইতো নীলা

-সে আর শুনবি। বলতেন মা “কি যে বল” বলে সেদিন কথাটা হেসে উড়িয়ে দেন বাবা। মা একটু থামেন এবং কি ভেবে তার মুখটা যেন তৃপ্তিতে রয়েছে। মা আবার শুরু করেন

-এর পরদিন তোর বাবার আর ফোন আসে না। ভাবলাম ব্যস্ত আছে, একটু পরেই করবে। বেলা দুপর একটা ছুই ছুই করছে। কোন ফোন নেই।  বাধ্য হয়ে আমি নিজেই রণে  ভঙ্গ দিলাম

-হ্যালো! বাবা ফোন ধরেন

-“কি ব্যাপার তুমি অফিসে আছতো’। ওপাশ থেকে জবাব আসে না। একটু সময় লাগে। পরে বলে বাবা

-না, না। অফিসেই আছি। একটু বেশী ব্যস্ত আর কি।

কিন্তু কথা আর কন্ঠস্বরে মা ঠিকই ধরতে পারেন। আর ভনিতা না করে সরাসরি সারেন্ডার করেন

-ঘাট হয়েছে। হার মানছি। মাফ চাইছি, এক দুই তিন। হলতো। এবার বল কি জানতে চাও

সাথে সাথেই বাবা যেন সজীব হয়ে গেলেন

-হ্যগো! আজকের নীলার হাসিটা তোমার কাছে কেমন মনে হল।

এই তার সেই বাবা। এতটাই ভেঙ্গে পড়েছেন। আবার বাবার দিকে তাকায় নীলা। বাবা তার দিকে তাকিয়ে মিথ্যা হাঁসি দেবার চেষ্টা করছেন। বাবার সামনে দাড়িয়ে এক মুহূর্ত চিন্তা করে নীলা। এরপর পায়ে পায়ে নিজ রুমে ফিরে যায় সে। সারারাত সারাদিন ভাবে। তৃতীয় দিনে বাবার সমানে গিয়ে হাজির হয় নীলা। বাবা জানতে চান

-কিছু বলবি মা?

-হ্যা, বাবা। সাড়া দেয় নীলা

-তা বলে ফেল। বাবা স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করেন।

-বাবা

-কি বলতে চাস বলে ফেল

– তোমার জন্মভূমি দিনাজপুর থেকে যারা প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল-মা গতকাল বললেন-তারা নাকি এখনও অপেক্ষা করছে। তুমি সব ব্যবস্থা করে ফেল বাবা। তবে শর্ত একটাই বিয়েতে কোন জাকজমক হবে না। আর শাড়ীটা যেন দেশের একটা সাধারণ পরিবারের সামর্থের বেশী না হয়। আর ওদের বলো ওরা যেন ওদের পরিবারের বাইরের কাউকে না আনে।

পরের কথাগুলো বাবা যে শুনলেন তা মনে হল না। নীলা দেখল বাবার শরীরে জীবন ফিরে এসেছে। তিনি বললেন

-তুই কি ভেবে-চিন্তে বলছিস মা?

-হ্যা, বাবা। একদিন এক রাত ভেবেছি। বাবার কাছাকাছি এগিয়ে গেল নীলা। তারপর বলে

-এবার আমার মাথায় হাত দিয়ে একটা হাঁসি দাওতো বাবা।

বাবা যা কখনও করেননি তাই করলেন। নীলার কপালে একটা চুমু খেয়ে বললেন

-সোনার মা মনি আমার! ছেলেটা আমার খুবই পছন্দ। তাকে আমি আগে থেকে চিনি। আমার বিশ্বাস তুই অপছন্দ করবি না। তবে আগে জোর দিয়ে বলার সাহস পাইনি।

পাত্র নীলার বাবার ছোট বেলার বন্ধুর ছেলে আহসান। তবে বাবার নির্বাচনের এটাই প্রধান কারণ নয়। নিজে বিভিন্ন জনের কাছে খোঁঝ-খবর নিয়ে সবখানে একই জবাব পেয়েছেb। এ সময়ে তার এক বন্ধু জানাল ছেলে রাজি হতে চাচ্ছে না, আবার ছেলের বাবাও নাছোড় বান্দা। কনে বাবার পছন্দ এবং সে পছন্দ খোঁঝ-খবর নেবার পর। নিজে একজন সৎ ও নীতিবান মানুষ এবং খোঁঝ নিয়ে জেনেছেন কনেও তেমন ব্যক্তিত্বের অধিকারী। দেখতে-শুনতে আহামরি না হলেও সহজে পছন্দ করার মতো। আহসানের আপত্তি মেয়ে নামাজে নিয়মিত নয়, বোরখা পরে না-যা সে কনের বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন এক ছাত্রীর মাধ্যমে সংগ্রহ করেছে। বাবার কথা হচ্ছে মেয়ে যেহেতু সৎ ও নীতিবান এবং সত্যবাদি হিসেবে পরিচিত সেহেতু বিয়ের পরে ভালো কিছু আশা করা যেতে পারে। বাবার আরো যুক্তি এমন শক্ত মানের মেয়ে পাওয়া দুস্কর বিশেষ করে আহসান তার নিজের জীবন নির্বাহ ও পরিচালনা নিয়ে যেভাবে মাইন্ডসেট দাড় করিয়েছে, তাতে এমন মেয়েই তার জন্য উপযুক্ত। বাবাকে তার এমন শক্ত অবস্থান থেকে টলাতে না পেরে, মাকে অনুরোধ করলো বাবাকে এ প্রস্তাব থেকে সরিয়ে আনার জন্য। কিন্তু সে চেষ্টাও ব্যর্থ হোল। বাবার দু’একজন নিকট বন্ধুও ব্যর্থ হোলেন। শেষে আল্লাহর উপর ভরষা করে ‘নিরুপায়’ রাজি হোল আহসান।

একদিন পর বাবা কনের বাবা অর্থাৎ বাবার বন্ধুর উদ্ধৃতি দিয়ে আহসানকে জানালো, কনে অতি সাদামাটা পোশাক ও সাজে বিয়ের আসনে বসতে চায়-যে ব্যাপারে সে অনঢ়। কথাটা শুনে মেয়েটির প্রতি সে এই প্রথম আকর্ষন অনুভব করলো আহসান। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের যার কাছ থেকে সে কনের ব্যাপারে খোঁঝ নিয়েছিল, তার কাছে বিষয়টি জানতে চেয়ে উত্তর পেল ‘নীলা মনে করে একটি গরীব দেশের মেয়ে হিসেবে সামর্থ থাকলেও বিয়ের খরচে বাড়াবাড়ি না করে বরং বাঁচানো টাকা একটি সৎ অথচ গরীব মেয়ের বিয়ের পিছনে ব্যয় করাটাই একজন আদর্শ নাগরিকের দায়িত্ব। বিষয়টি জানার পর আহসান এক বড় আশা নিয়ে বাবাকে বিয়ের প্রস্তুতি সময় মতো শেষ করতে বললো।

আহসানদের বাড়ী অনেক দুরে হওয়ায় বাবার অনুরোধে আগেই ঠিক করা ছিল বিয়ের রাতে বর নীলাদের বাসাতেই থাকবে। বাসর সাজান হয়েছিল নীলাদের বাড়ীতেই। সে রাতে বড় করুন দৃষ্টি নিয়ে নীলা তাকিয়েছিল আহসানের দিকে। শুধু অনুরোধ করেছিল একটু সময় দিতে, তাড়াহুড়া না করতে। তবে সময়ের কোন সীমা ঠিক করা হয়নি। বরং আহসান প্রসঙ্গ পাল্টে বলেছিল

-তোমাকে খুব ক্লান্ত মনে হচ্ছে। একটু ঘুমোনের চেষ্টা কর।

সে রাতের সে দায়িত্ব সচেতনতার কন্ঠস্বর নীলার স্নায়ুতে যেন কি এক বিদ্যুতের সঞ্চাচালন এনে দিয়েছিল। ভাবটা এমন যেন স্বামী সফর থেকে ফিরে ক্লান্ত তথাপি খানিক অসুস্থ্য স্ত্রীকে দেখে সমবেদনায় লুটিয়ে পড়েছে। একবার আহসানের দিকে তাকাতে ইচ্ছা হয়েছিল নীলার কিন্তু তার নার্ভাস সিষ্টেম তাতে সাড়া দেয়নি। এরপর আহসানের কন্ঠ্ তার কানে এসেছিল

-এশার নামাজটা এখনও পড়িনি। এসো এক সাথে নামাজ পড়ি। তারপর তুমি বরং ঘুমিয়ে পড়। আমি বাড়তি নামাজে আমার রবের সাথে কিছু বিশেষ কথা বলব, একটু সময় নেবে।

বেরিয়ে যেতে থাকে আহসান, একটু এগিয়ে গিয়ে পিছনে তাকায় সে। চোখ সরিয়ে ফেলেছিল নীলা। শুধু শুনেছিল

-আজতো অনেক রাত জাগা হল। যদি আগে উঠতে পার তবে আমাকেও জাগিয়ে দিও।

আর একবার ধাক্কা খেল নীলা। বাসর রাতের শ্বাসত দেনা-পাওনার প্রশ্নও তোলেনি আহসান। সকালে ঘুম ভাঙ্গনোর দায় না থাকলেও জেগে উঠে দেখে খাটে আহসান নেই। বাথরুমের দরজার নীচে আলো দেখে বুঝলো আহসান একটু আগে উঠেছে। আযান শোনা যাচ্ছে। কিছুটা চুপসে গেল নীলা। সেতো নিজে নামায পড়ে কালে-ভদ্রে। সেদিন সে মুহূর্তে একটু নার্ভাস হয়ে পড়েছিল নীলা। নিজের মধ্যে একটা খোঁচা অনুভব করলো সে। সারা রাতে একটি বারের জন্য হলেও লোকটির খোঁজ নেয়নি সে। অথচ সে এ বাড়ীর সম্মানীত ও ব্যতিক্রমি এক বিশেষ অতিথি, অন্তত: তার বাবার প্রিয় মানুষ। কিন্তু এ ভাবনাকে পরক্ষনেই অপ্রয়োজনীয় মনে করলো নীলা।

সকালে বাসর ঘর থেকে বেরিয়ে হাফ ছেড়েছিল নীলা। দাঁত ব্রাশ করে ঘরে এসে স্বাভাবিকতা ফুটিয়ে তুলতে চুল আচড়াতে থাকে সে। প্রতিটি মুহূর্ত অসহ্য লাগছে তার কাছে। মাকে সে আগেই বলে দিয়েছে তাকে যেন কোন কাজ দেয়া না হয়’ এমনকি কারো সামনে ট্রে পৌঁছে দিতেও বলা না হয়। দুপুরের খাবারের পর নীলা গেল বাবার রুমে। দেখেই বাবা তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে উঠে বসলেন। জানতে চাইল নীলা

-বাবা, তোমার শরীর এখন কেমন?

বাবাকে বেশ প্রফুল্ল মনে হলো নীলার। অনেক কষ্টে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে নীলা। বাবার মুখে হাসি ফোটাবার জন্য এমনটা তাকে পারতেই হবে। বাবার মুখ দেখে বুঝল নীলা, বাবা তার ভিতরটা পড়ার চেষ্টা করছেন।  জানতে চাইলেন বাবা

-আমাকে কি কিছু বলবি? জামাইকে কেমন মনে হল?

-সে কথা থাক বাবা, পরে হবে। এখন বল তোমার ব্যাথাটা কেমন?

-আমি ভাল মা, ব্যাথাটা এই ভাল হল বলে। সারা মুখে হাসির আভা ছড়িয়ে দেন বাবা। নীলা নিজেই ব্যর্থ হাঁসি দেবার চেষ্টা করে আর ভাবে ‘কিছুটা তাকে পারতেই হবে’। স্নেহ প্রবন বাবার সে কৃত্তিমতাটুকু বোঝার সময় থাকে না নীলার।

এ বিয়ে হওয়ায় বাবার মন ও শরীরের পরিবর্তনটা বাসার কারো বুঝতে কষ্ট হবার কথা নয়। মেয়েকে খুশী করার জন্য বাবা যেন এবারে অতিরিক্ত এগিয়ে গেলেন

-বিয়েতে তোর বান্ধবীরা কেউতো এলো না। আজ সবাইকে বিকেলের নাস্তার জন্য ডাকি। অবুঝ বাবা নিজের মনকে ব্যস্ত করে তোলেন কেননা মেয়েকে তিনি স্বাভাবিকই দেখছেন। নিজেকে আর সামলাতে পারে না নীলা। এবারে প্রতিবাদ করে  সে

-বাবা! নীলার কন্ঠটা বড় অস্বাভাবিক ও ভারী শোনায় বাবার কাছে।  তিনি যেন ঘাবড়ে গেলেন। তবে সে খেয়াল করল, বাবার মুখটা যেন এই একটু আগের সতেজতা হারিয়ে ফেলেছে।

-আমিতো আজ লাঞ্চের পর শ্বশুর বাড়ী চলে যাচ্ছি বাবা। তাহলে কি করে সম্ভব?

পরিস্থিতি সামলে নেবার চেষ্টা করে নীলা। বিষয়টা সে না চাইলেও মাথায় আসা যুক্তিটা চালিয়ে দিল। বুঝতে পারে নীলা  বাবার মনের খচখচানিটা আরো চলবে। অথচ সে চায়নি বাবাকে কষ্ট দিতে। অসতর্কতার কারনে ভুলটা হয়ে গেল। সামলাতে খানিকটা হাসি ছড়িয়ে সে বলল

-আমাকে কবে দেখতে যাচ্ছ বাবা? দেরী করলে আমি কিন্তু রাগ করব? তাছাড়া তোমার পছন্দের জামাইর সঙ্গে কিছু সময় কাটাতে পারবে তখন।

এবারে বাবা আবার সাবেক প্রফুল্লাতায় ফিরে আসতে চাইলেন কিন্তু পারলেন না। এতে কষ্ট হল নীলার। এ পর্যন্ত বহু কষ্ট সে করল বাবার জন্য কিন্তু শেষ পর্যন্ত এ কি করল সে। ঠিক এ সময় একটা কান্ড করে বসল নীলা

-বাবা চা খেয়েছ? মাথা নাড়েন বাবা ‘খাননি’

-তাহলে এক কাজ কর। ওর কাছে গিয়ে কথা বল। আমি চা করে নিয়ে আসছি। খানিকটা হতবুদ্ধি হয়ে পড়েন বাবা। কিছুক্ষন মেয়ের দিকে তাকিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যান।

চা হাতে নিয়ে সেদিন আহসানের ঘরে বাবাকে পায়নি নীলা। শুধু আহসানকে ঘরে দেখে অপ্রস্তুত হয়েছিল সে। বাবার উপর রাগ এসে পড়ে তার। অথচ ফিরতেও পারছে না। কোন কথা না বলে আস্তে করে ট্রেটা টেবিলের উপর নামিয়ে রাখে সে। তারপর চুপচাপ।  কথা বলল আহসান

-আর কাউকে দিয়ে পাঠালেইতো চলত। বরং আরো খানিকটা ঘুমিয়ে শরীর-মনকে হালকা করে নিতে পারতে।

অহেতুক দয়া দেখাবার জন্য মনে মনে রেগে যায় নীলা। আবার অবাক হয় নীলা, ‘যে লোক রাতের অনেক্ষন জায়নামাজে উঠে বসে কাটাল সে কিনা তাকেই ঘুমানোর পরামর্শ দিচ্ছে’। নাকি দয়া দেখাচ্ছে? আর ভাবতে পারে না নীলা। এরা সবাই একই রসুনের কোয়া। সহানুভূতি আর ভাবনার বহর দেখে বিরক্ত হয়ে পড়ে নীলা। আজ বোঝে সৌরভও এমন দরদ দেখাত যা তখন তার কাছে প্রানজ মনে হত। একটা শক্ত উত্তর নীলার মুখে এসে আর থেমে থাকতে পারল না। প্রতিশোধ নিল সে

-শরীরটা যখন আমার তখন আমার জন্য আপনার শরীরটাকে কষ্ট নাইবা দিলেন।

খেয়াল করল নীলা, অনায়াসেই কথাটাকে হজম করে নিল আহসান। যেন কিছুই হয়নি। তার কথাটার গুরুত্ব উপলব্ধি করে এবং আহসানের নির্বিকার অবস্থা খেয়াল করে ভিতরে তেলে-বেগুনে জ্বলছে নীলা। দিয়েশলাইয়ের কাঠি দিয়ে দিয়েশলাই বাক্সে দিল এক জোরে ঘষা

-নাকি বিয়ে করে আমার শরীরটার মালিকও বনে গেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কথাটা বলে না নীলা। এ সময় বাবা  এসে দরজায় নক করলেন। ততক্ষনে নিজেকে সামলে নিয়েছে নীলা। বলে

-বাবা এতক্ষন কোথায় ছিলে। আমি সেই তখন থেকে অপেক্ষা করছি। মনে হচ্ছে দুনিয়াতে তুমিই বোধ হয় একমাত্র বাবা যে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছে। যেন একটা মহাকিছু।

মৃদু হাসেন বাবা। চায়ের কাপটা বাবার দিকে এগিয়ে দেয় নীলা। এরপর ট্রেটা ঠেলে দেয় আহসানের দিকে। বাবা বিষয়টা খেয়াল করার আগেই চায়ের অপর কাপটা হাতে নেয় আহসান।

-তোমরা কথা বল বাবা। আমি মিনার কাছে একটু যাব। তড়ি-ঘড়ি করে বের হয়ে গেল নীলা। আহসানের উপর রাগটা তার তখনও পড়ে না।

বিকেলের দিকে বরের বাড়ীতে রওয়ানা হবার পালা। পৌঁছুতে পৌঁছুতে সেদিন রাত হয়ে যায়। শ্বশুর বাড়ী পৌঁছে বর-কনের জন্য বরাদ্দ ঘরের দিকে তাকায় নীলা। প্রয়োজনীয় সব দিয়ে সাজান রুমটা। খাটের দিকে তাকিয়ে একটা বাঁকা হাসি দেয় নীলা। তাকে ভোলাবার জন্য স্বর্গ রচনা করা হয়েছে। কোন কথা না বলে টয়লেটে প্রবেশ করে নীলা। টয়লেট সেরে রুমে ঢুকতেই সে এক মহাবিস্ময়ের পালা। ব্যাকটেরিয়ার বাইনারী ফিশনের মত খাটটা যেন দু’ভাগ হয়ে গেছে। চাদরও দু’টো বিছান। কিন্তু এসব নিয়ে ভাবনার সময় নেই নীলার। তবে মনে মনে ব্যবস্থাপককে অশেষ ধন্যবাদ না দিয়ে পারে না সে। তাহলে বিছানা আলাদাটি কি আহসানই করেছে! অথবা আমার অবস্থা বুঝেই বাসায় আসার আগেই সে এ ব্যবস্থা করে রেখেছে। নিশ্চয় কাজটি করা তার জন্য সহজ ছিল না। তাছাড়া বাড়ীর মানুষতো এটা সহজে মেনে নেবার কথা নয়। তাহলে কি এ বাড়ীতে সবাই আহসানকে গুরুত্ব না দিয়ে পারে না। ভাবছে নীলা ‘এ কেমন মানুষ, কি দিয়ে তৈরী’। নাকি লোকটা তাকে জয় করার জন্য বোকার মত তাকে ধোকা দিচ্ছে। কিন্তু নিজের সাথে ততটা একমত হতে পারল না নীলা। যাক, এতসব নিয়ে ভাবনার সময় নেই নীলার। সরাসরি দেয়ালের সাথে লাগানো বিছানাটায় শুয়ে পড়ল সে।

পরদিন ইচ্ছা করেই দেরী করে ঘুম থেকে উঠলো। নাস্তার বাহার দেখে বিরক্ত হয়ে ঝি-কে মৃদু ধমক দেয় নীলা। খানিক পরে ঝি আসে ট্রে নিতে কিন্তু সব আস্ত পড়ে আছে দেখে ফিরে যায়। ঝিকে ‘আর না আসতে’ হুকুম করে নীলা। সে ইচ্ছে হলে খাবে, না হলে খাবে না। তাকে নিয়ে অন্যের ভাবনা কেন? আর খেতেই যে হবে তার কোন বাধ্যবাধকতা থাকতে হবে কেন। এতক্ষনে বাবার কথা মনে হল নীলার। “বাবা তুমি খুশী হও আর আমাকে ভুলে যাও। কিন্তু খবরদার ভিতরের খবর নিতে চেও না। তাতে তুমিই বেশী দু:খ পাবে”।

সেদিন গোসল সেরে এ জানালাটার পাশেই প্রথম বসেছিল নীলা। বুলবুলির বাসাটা তখনও শেষ হয়নি। পদশব্দে ফিরে তাকায় নীলা। আহসান এসেছে। আবারো বুলবুলির বাসাটার দিকে তাকায় নীলা। নিশ্চয়ই আহসান দয়া বা সহানুভূতি দেখাতে এসেছে। বড় অসহ্য এ সব। তাছাড়া সে খাবে কি খাবে না, সে দায়িত্বতো সে তাকে দেয়নি নীলা। চুপচাপ অনেক্ষন। এক সময় বলে ওঠে আহসান

-তোমার হয়ত আমাকে কিছু বলার আছে? মুরুবাবীয়ানা দেখে আসহ্য লাগে নীলার। একটু সময় নিয়ে মুখ খোলে

-দেখুন বলার দরকার হলে আপনাকে কষ্ট করে আসতে হবে না। আমিই ঝিকে দিয়ে ডেকে পাঠাব। কোন দয়া বা সহানুভূতির দরকার হলে আপনাকে জানাতে ভুলব না, কথা দিচ্ছি।

কপালের চামড়াটা খানিক কুচকে থাকে আহসানের কিন্তু তা ক্ষনিকের জন্য। তারপর সেই স্বভাবিক। সে প্রথম দিনের মত। বসে পড়ে সে সোফায়। অনুমান করে নীলা ভদ্রলোক এবার জ্ঞান-গরীমার বক্তিমা শুরু করবেন। কিন্তু না আহসান সেদিকে গেল না। বরং পাল্টা প্রশ্ন করল

-কিন্তু আমার বাসায় নতুন করে আসা কারো কোন অসুবিধা হচ্ছে কিনা তা জানার এতটুকু অধিকারতো আমার থাকবে?

না, আর চুপ থাকা যায় না। যাকগে ভদ্রতা আর অভদ্রতা।  কসে মুখ বেধে নিল নীলা

-ধরুন যদি বলি, এখানে আমার একটুও থাকতে ইচ্ছা করছে না, তাহলে কি পারবেন আমাকে এ মুহূর্তে আমার বাবার কাছে পাঠিয়ে দিতে।

ধাক্কা খেলেও বেশ সামলে নেবার চেষ্টা করল আহসান। খানিক্ষন বিরতি। এক সময় বলল সে

-কি বলছেন তা কি খেয়াল করছেন?

-হ্যা, হ্যা ভালভাবে খেয়াল  করেছি। এখানে আমার একটুও ভাল লাগছে না। বাবার কাছে গেলে স্বস্তি পাব।

নীলার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকল আহসান। ভাবনায় পড়ে সে। তার সেই নির্লিপ্ত চোখ আর স্বাভাবিক চাহনি। কন্ঠস্বরটাও তেমন।

-তাই হবে। শফিতো কলেজে চলে গেছে। ঠিক আছে অসুবিধা হবে না। ব্রেক জার্নি করে কোচেই সুবিধে হবে। বের হয়ে গেল আহসান

ততক্ষনে নীলার শরীরে ঘাম ছুটছে। সেই সাথে কেমন জানি দূর্বলও লাগছে। আহসান যে এত সহজেই রাজি হবে তা সে ভুলেও ভাবতে পারেনি। এ বাড়ীতে তার আসা চব্বিশ ঘন্টাও হয়নি। তাহলে কি আহসানকে জব্দ করতে গিয়ে সে নিজেই পরাজিত হল আর আহসান জয়ী হল। আর ভাবতে পারে না নীলা। সত্যিতো এখানে আসার পর নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তার। সে যাই হোক। তবুও সে বাড়ীতে ফিরে যাবে। আর এক মুহূর্তও সে এখানে থাকতে রাযি নয়। আহসান রাযি হয়েছে ভালই হয়েছে। হঠাৎ মনে হল আহসান কি তাকে আবারো দয়া দেখাচ্ছে? কিন্তু এতসব ভাবার সময় তার নেই। ইতোমধ্যেই মনের জগতে সে তো বাড়ীতে চলে গেছে বাবার কাছে।

ঘর থেকে বের হয়ে আহসান মা-বাবাকে একত্রে ডাকল। তাদের সাথে কয়েক মিনিট কথা বলল। তারপর ফিরে এসে নীলাকে পরদিন সকালের জন্য তৈরী হতে বলল।

সন্ধার কিছুক্ষন পরেই বাবার কাছে পৌঁছে গেল নীলিা। বাড়ীর সবাইতো হতবাক। মা-ই আগে ধা ধা করে ছুটে এলেন। কোন কথা না বলে হন হন করে নীলা নিজ রুমে চলে গেল কিন্তু আহসান কি বলে সেদিকে কান লাগিয়ে রাখল। বাবা তখনও তার আসার খবর পাননি । মাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়েই সালাম দেয় আহসান। ততক্ষনে বাবা এসে হাজির। তখনই দ্রুত মুখ খোলে আহসান

-মা-বাবা! নীলাকেই জিজ্ঞেস করে দেখুন আজকের জার্নি কতটা কষ্টের ছিল। কিছু না খেলে মুখ খুলতে পারব না। একবারও পারব না। আগে কিছু খেতে দিন। তারও আগে ঠান্ডা পানিতে গোসল করা দরকার। এরও আগে দরকার এক গ্লাস লেবুর শরবত। না থাকলে দয়া করে আপনাদের গাছ থেকে তুলে আনুন।

একটু দম নেয় আহসান। মা-বাবার চোখ-মুখ থেকে তখনও বিস্ময়ের ঘোর কাটেনি। আবারো তাগিদ দেয় আহসান, কন্ঠস্বরে খানিকটা আবেগ মেখে

-জানেন, আমার আম্মু অনেক আগেই আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়েছেন। এখন আপনি আমার সে অভাব পূরণ করেছেন। তবুও মনে পড়ে.. কথাটা বলে একটু ঢোক গিলে নেয়। তারপর আবার বলতে থাকে সে

-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাত্র দু’-তিন দিনের জন্য বাড়ীতে আসতাম। আর মা তাতেই লঙ্কা কান্ড বাধাতেন। তখন মনে হত ‘কতই না ভাল হত যদি বাড়ীটা বিশ্ববিদ্যালয় হোত’। বিরানী-পোলাও, ভুনা করিজা, ইলিশ ভাজি থেকে শুরু করে একটা সাধারণ পিঠাও বাদ পড়ত না। তখনকার সে দিনগুলো আপনাকে দিয়ে ফিরিয়ে আনতে চাই মা।

মার চোখ দু’টো পানিতে ভরে উঠেছে। বাবাও তাই। মা আর স্থীর থাকতে পারেন না

-আমি তোমার সেই মা হব বাবা। তোমার মার মত না পরালেও চেষ্টা করব অবশ্যই। যাও তাড়াতাড়ি হাত মুখ ধুয়ে নাও। আমি লেবুর শরবত নিয়ে আসছি। এবারে সন্তানদের হাকেন।

-কিরে তোরা কি দেখছিস। মিনা গোসল খানাটা একটু পরিস্কার কর। আর শফি তুই চটজলদি বাজার করে নিয়ে আয়।

সবই শুনল নীলা। আর অবাক হলো ভেবে ‘কি ভাবে সে এমন একটা অপ্রীতিকর কঠিন পরিস্থিতিকে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক করে ফেলল’। সৌরভ হলে কি তা পারত? কোন জবাব এল না ভিতর থেকে।

এবারে স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলে আহসান। স্বামীকে তাগাদা দেন নীলার মা

-তা তুমি দাড়িয়ে না থেকে ঘোষের বাসায় গিয়ে ভাল দই নিয়ে আস।

বের হয়ে আসে নীলা। এবারে অপলক নেত্রে তাকায় স্বামীর দিকে। একটা ভিন গ্রহের নীতি আর মানুষকে আপন করে নেয়ার যাদু জানা কেউ কি সে? নাকি কোন স্বর্গীয় ফ্যাক্টরীতে তৈরী সে।

অফিস ধরার জন্য সে রাতেই ফেরার টিকিট আগেই করেছিল আহসান। সন্ধার বাসেই ফিরে যাবে সে। বুঝতে পারে নীলা মা-বাবা এখন আহসানের সাথে। শুনতে পায় নীলা, বের হবার আগে বলছে আহসান

-বাবা! আমার মত আপনিও এক সময় নববিবাহিতা ছিলেন। সব না জানলেও শুধু এতটুকু জেনে রাখুন আমার সুবিধার জন্য আমি নীলাকে কিছুদিনের জন্য এখানে রেখে যাচ্ছি। আর নীলা এখনো ছেলে মানুষ। তাছাড়া আরো কিছু বিষয়ে খেয়াল রাখতে না পারায় নিজের দোষ স্বীকার করে দু:খ প্রকাশ করছি।  আমাদের এ সব ব্যাপারে ওকে কিছু জিজ্ঞেস না করাই ভাল হবে। তবে নিশ্চিত হবার জন্য আপনাদের একশত ভাগ অভয় দিচ্ছি, নীলা আমার কাছে পরম যত্নেই থাকবে। শুধু কিছুটা সময় ধৈর্য ধরতে হবে। গতকালই আমি নীলার অতীত জেনেছি। সমাজে হাজারো-লাখো নীলা তার স্রষ্টাকে চিনতে না পেরে শয়তানের সাথে আপোষ করে, তার দেখানো কুপথ ধরে। এ জন্য নীলার কিছু দায় নেবার থাকলেও সিংহ ভাগের দায় পড়ে আমাদের সমাজ আর শিক্ষা ব্যবস্থার মৌলিক ঘাটতি এবং বিপথগামীতার উপর। একটু বিরতি নিল আহসান

-আপনারা আমাদের নিয়ে মোটেও ভাববেন না। নীলার হাতটা আমার হাতে নেব বলে বহুদিন ধরে অপেক্ষা করেছি। আখেরাতে সফল হবার জন্য আমার যে জীবনোদ্দেশ্য তা অর্জনের জন্য নীলার মত ব্যক্তিত্ব আর সুবচনের একজন জীবন সঙ্গীনি আমার বড় প্রয়োজন। ওর যে মানসিক অবস্থা তাতে ওর ব্যবহারকে অস্বাভাবিক নয় বরং স্বাভাবিক ধরেই সামনে এগোতে হবে। গোটা কয় সপ্তাহ অপেক্ষা করুন, দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে। সম্ভব হলে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে আমাদের আখেরাতের সফলতার জন্য দোয়া করবেন।

এরপর পা পা করে নীলার রুমে ঢুকল আহসান । বলল

-একটা অনুরোধ রাখতে মিনতি করছি। যদি সুযোগ দেন।

কথা বলছে না নীলা। আবার বলে আহসান

-দাবীতো করছি না, অনুরোধ করছি।

এ ভাবে বলার পর কি করে চুপ থাকবে নীলা। সাড়া দিল

-সম্ভব মনে করলে চেষ্টা করবো।

হাত বাড়িয়ে পিনগাথা একটা কাগজ তুলে দিল সে নীলার হাতে। বলল

-সময় পেলে এ লেখাটা পড়বেন। হয়ত একটা আলোর ফোয়ারা দেখতে পাবেন।

-কথা দিচ্ছি না, তবে চেষ্টা করব।

-কষ্ট করে অনুরোধে সাড়া দেবার জন্য ধন্যবাদ।

বেরিয়ে গেছে আহসান। আর ফিরে তাকায়নি। তাকালে হয়তবা জানালার আগল দৃষ্টি ছুড়ে দেওয়া এক যুবতির অস্বাভাবিক কিছু নযরে পড়ত।

সেদিন স্বামীর গমন পথে স্বয়ংক্রীয় তাকিয়ে ছিল নীলা, আড়াল না হওয়া পর্যন্ত। আশ্চর্য মানুষ আহসান। নিজের গায়ে দোষ মেখে নিল আবার জবাবদিহী না করার ঝামেলা থেকে নীলাকেও মুক্ত করে গেল। যাবার আগে মা-বাবার কাছে প্রত্যয়ের কথাগুলোতেও নীলা অবাক না হয়ে পারল না। নিজের প্রতি এত অগাধ বিশ্বাস তার। কোথা থেকে পেয়েছে সে এসব। পিছন দিক থেকে মা-বাবা দেখলেন ‘নীলা তার স্বামীর গমন পথে চেয়ে আছে’, তাই তারা কিছু আর জিজ্ঞেস করার ততটা প্রয়োজন মনে করলেন না।

আহসান চলে যাবার পর থেকে বাড়ীতে নীলা কেন যেন স্বস্তি পাচ্ছিল না। একা একা লাগছিল। কি যেন নেই। কে সেটা। পুরোন স্মৃতিগুলো বার বার শ্বাস রোধ করতে যেন তেড়ে আসলেও সুবিধা করতে পারছিল না। অনুভব করল, কোথাও যেন একটা শুন্যতা বিরাজ করছে। বড় অস্বস্তিকর। এ বাড়ীতে সৌরভ শত সহস্রবার এসেছে, খেয়েছে। এ বাড়ীর প্রতিটি ইট-পাথর, ধুলিকনা তার সাক্ষী। কে যেন বলছে ‘এ গোটা বাড়ীটা অপবিত্র’। এমন একটা মিথ্যুক, প্রতারক আর ওয়াদা ভঙ্গকারীকে কেন সে চিনতে পারল না। যারা নীলাকে এতদিন বুদ্ধিমান বলেছে তারা সবাই বুদ্ধিহীন। সে নিজে আসলে একটা বেকুব। হ্যা, একজনকে চাই যে তাকে পবিত্র করবে।

ইতিমধ্যেই এক সপ্তাহ পার হল। এ পর্যন্ত মা-বাবা আহসানের প্রসঙ্গ তোলেননি। তারা খানিকটা চিন্তিত হলেও সব কিছুকে স্বাভাবিক হিসেবে মেনে নিয়েছেন। বিশেষ করে আহসান যে অভয় দিয়েছে তাতে তারা অনেকটা নিশ্চিন্ততা নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন।

বিকেলে ভাবছিল একটু শপিংয়ে যাবে নিছক সময় কাটানোর জন্য। এ সময় মিনা একটা চিঠি এনে হাতে দিল। ঠিকানায় হাতের লেখাটা চিনতে পারল না নীলা। চিঠিটা খুলেই পড়া শুরু করল।

প্রিয়তমা নীলা

আসসালামুআলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহে ওয়া বারাকাতুহু। মানব সমাজের একটা জিনিষ সহজেই তুমি বুঝতে পারবে যে, বিবাহ বন্ধনটা সভ্যতার শৃংখলা ও স্বাভাবিক যাত্রা অব্যাহত রাখার জন্য এক অপরিহার্য্য বিশেষ বিধির ইসলামী ব্যবস্থা। তাইতো তোমায় আমি শুধু দৈহিক বা বস্তুগত প্রয়োজনে বিয়ে করিনি বরং করেছি এক বৃহত্তর নৈতিক এবং মৃত্যুহীন এক সুখের জীবন পেতে পথ চলার সাহায্যকারী হিসেবে। আর মুসলিমদের জন্য এটাই হল বৈবাহিক দর্শনের মৌলিক ভিত্তি। অতএব বুঝতেই পারছ প্রয়োজনটা আমার কত বেশী।

আর দয়ার কথা বলছ! যেটুকু করা উচিৎ বলে মনে করি এবং যতটুকু করেছি সেটা শেষ বিচারের দিনে আত্মরক্ষার জন্য আমার নিজের স্বার্থে বাধ্যতামূলক নূন্যতম করণীয়। সত্যি বলতে কি, তাতে তোমার স্বার্থের চেয়ে আমার স্বার্থকেই বার বার দেখেছি। তাই যতদিন এ বাঁধন টিকে থাকবে ততদিন তুমি এড়িয়ে চললেও চুড়ান্ত সফলতার প্রয়োজনে আমি তোমার সান্নিধ্য পেতে বিমুখ থাকতে পারব না।

প্রয়োজনে খবর দিও, আমি আসব।

ইতি

অপেক্ষারত আহসান

বক্তব্যটা খুবই নতুন নীলার কাছে। একটা নতুন চিন্তাদর্শনের উন্মেষ। ভাবছিল নীলা। কিন্তু তা কি আসলেই নুতন। আমরা যেটা জানার জন্য চেষ্টা করিনি, গুরুত্ব দেইনি-আহসান হয়ত বহু আগেই তা দিয়েছে। চিঠিটা আবার পড়ে নীলা। আবারো পড়ে। বার বার পড়ায় বক্তব্য আরো স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে। এ সময় মনে পড়ল আহসানের দেয়া পিন গাথা সেই কাগজটার কথা। খুঁজতে খুঁজতে এক সময় পেয়েও যায় সেটা। মেলে ধরে সেটা পড়তে থাকে নীলা। শিরোনাম হচ্ছে “সাহাবারাই ছিলেন সব থেকে স্মার্ট জনগোষ্ঠী”। কথাটা কেন জানি বেখাপ্পা মনে হল নীলার কাছে। সাহাবাদের সাথে আবার স্মার্টনেসের কি সম্পর্ক। তারাতো শুধু নামাজ-কালাম, হজ্ব-যাকাত, পরকাল, বেহেস্ত নিয়ে ছিলেন। স্মাটনেসতো এ যুগের মূলত একালের যুব-যুবতীদের ব্যাপার। মনে মনে বলে নীলা ‘আচ্ছা দেখিনা কেন, ভিতরে কি বলেছে’।

পড়া শুরু করল নীলা। প্রথম প্যারাগ্রাফটা পড়েই কেন জানি তার শরীর আর মন একটা বড় ঝাকুনি খেল। মনে হচ্ছে পশম খাড়া হয়ে পড়েছে। লেখাতে যা বুঝাতে চাওয়া হয়েছে তা এই যে, নিজের লাভালাভ যারা বুদ্ধিমত্তা এবং দক্ষতার সাথে বুঝতে ও ব্যবহার করতে পারে তারাই স্মার্ট। কিন্তু এ স্মার্টনেসের বিষয়টাতো দুনিয়ার লক্ষ্য অর্জনে সীমাবদ্ধ থাকার কথা নয়। এবং তা এ জন্যই নয় যে,  জীবন দুনিয়াতে চিরদিন টিকে থাকে না। এবং আখেরাতের তুলনায় এ জীবনটা হচ্ছে ঠিক ততটা, যখন দীর্ঘ সফররত একজন মুসাফির ক্লান্ত হয়ে পড়লে গাছের নীচে ক্ষনিক বিশ্রাম নেয়। দুনিয়ার জীবনটা এতটাই অনুসম যে, এখানে যারা নিজের দুনিয়ার কল্যানের জন্য বুদ্ধি ও দক্ষতা ব্যবহার করছে, তারা কি করে বুদ্ধিমান হয়? দুনিয়ার এ সময়তো ধর্তব্যের মত কোন সময় নয়। কারণ দু’চোখ বোজার সাথে সাথে দুনিয়ার সম্পদ পর হয়ে যাবে, আরাম-ভোগ বন্দ হয়ে যাবে। সাহাবারা দিব্য দৃষ্টিতে বুঝতেন যে, সময়ের হিসাবে  দুনিয়ার জীবন কিছুই না, তাই আখেরাতের বিলাসবহুল স্থায়ী যুবা জীবন পাওয়ার কাজকেই তারা একমাত্র প্রায়োরিটিতে নিতে পেরেছেন। এবং সে প্রায়োরিটি বাস্তবায়ন করেছেন সর্বোচ্চ্য পর্যায়ে, সব কিছুর উপর গুরুত্ব দিয়ে আল্লাহর পথে বিরামহীন চলেছেন, কুরআন-সুন্নত অর্পিত দায়িত্ব পালনে কখনো হেলা করেননি। আর সফল মুসলিমের জন্য যেহেতু মৃত্যুর পরে কবরের জীবনেই মুমিনের করা দুনিয়ার কর্মকান্ডের লাভ পাওয়া শুরু হয় সেহেতু মৃত্যুকে ভয় না করে বরং লোভনীয় মন নিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতেন, করতেন তৃপ্তীর সাথে। যেহেতু তাদের লাভ পাওয়াটা মৃত্যুহীন জীবন পাবার সাথে সাথে দুশ্চিন্তা-বিড়ম্বনাহীন সুখের জীবন পাওয়া, সেহেতু তারাই স্মার্টেষ্ট জনগোষ্ঠী। তারা এ লাভের বিষয়টি দুনিয়াতে ঠিকই বুঝেছিলেন। আর্টিকেলটি পুরো পাঠে স্থম্ভিত হয়ে পড়ে নীলা। আহসান কি এ সব বুঝেই নিজের জীবনকে এক বিশেষ ভাবে গড়েছে, সে অনুযায়ী নিজেকে চালাচ্ছে?

বেশ কয়েকবার পড়ার পর বিষয়টা আরো পরিস্কার হয় নীলার কাছে। সমস্ত শরীর তার ঘেমে উঠেছে, পশম খাড়া হয়ে গিয়েছে যেন। সত্যিইতো আমরা যেটা জানিনি, জানার চেষ্টা করিনি আহসান চেষ্টা করেছে। কাগজটা আবারো পড়ে নীলা। এবারে বক্তব্যটা তার কাছে আরও পরিস্কার হয়। মানব স্বভাব প্রকৃতি ও জীবন দর্শনের স্বাভাবিক দিকটির দিকে ইংগিত দিয়েছে আহসান। আসলেই যেটাকে সব থেকে গুরুত্ব দেবার কথা সেটাকেই আহসান বেশী গুরুত্ব দিয়েছে। সে বিশেষ অংশটা আবার পড়ে নীলা ”তাইতো তোমায় আমি শুধু দৈহিক বা বস্তুগত প্রয়োজনে বিয়ে করিনি। বরং করেছি এক বৃহত্তর নৈতিক এবং মৃত্যুহীন এক সুখের জীবন পেতে পথ চলার সহযোদ্ধা ও সাহায্যকারী হিসেবে।”

নিজের অতীতটার দিকে তাকায় নীলা। শুধু দৈহিক আর বস্তুগত প্রয়োজন মিটানো আর তার জন্য প্রতিযোগীতা করাই ছিল তার জীবন। অথচ সৌরভও এ সমাজের সদস্য, একই আবহাওয়ায় থেকে ও একই খাদ্য খেয়ে বেড়ে উঠেছে। আজ আহসানকে সে যদি মানুষ বলে তবে সৌরভকে কি বলা যাবে? হয়ত সৌরভ নারীর দেহকেই চেয়েছিল। এ জন্যই সে যখন আরো আকর্ষনের কাউকে পেল তখন তাকেই লুফে নিল। তার দুনিয়া ভোগের জীবন দর্শন পারল সহজেই নীলাকে ছুড়ে ফেলে দিতে। এ জন্য সৌরভের কোন কষ্ট হয়নি। হবার কথাও নয়। এতসব কে যেন নীলার ভিতর থেকে বলে উঠল। সে আরো বললো

-আহ! সৌরভ যদি আহসান হতো!

চমকে ওঠে নীলা। এমন একটা নোংরা মনের লোকের সাথে একটা পবিত্র মনের লোককে বসাতে পারল সে। ধিক তাকে! এ তুলনা সে করে কোন সাহসে।

নাহ! ঘুম আসছে না নীলার। নি:শ্বাস নিতে পারছে না সে। ’আচ্ছা শেষ বিচারের দিনে সফলতার জন্য যে করণীয় নীলার তাতে জন্য আহসানের কি কিছুই করণীয় নেই? আহসান কি সে কাজটা ইতোমধ্যে শুরু করেছে। বুঝতে পারে নীলা, আহসান তা ই্তোমধ্যেই শুরু করেছ। কিন্তু নীলা অক্ষম। সে কর্তব্য পালনের ক্ষমতা তার নেই কেননা তা পালনে সে মুর্খ। এখানে সে দরিদ্র। অত্যন্ত অসহায়। তার থলে শুন্য।

না, না; আর নয়। সে আর ভুলের উপর থাকতে পারে না।  এখানে বসে সে সময় নষ্ট করতে পারে না। তার পবিত্র স্বামীকে সে এখানকার বিষাক্ত আবহাওয়ায় আসতে দিতে পারে না। বরং সে নিজেই যাবে স্বামীর কাছে। ক্ষমা চেয়ে নেবে এ বলে যে, নিজ ধর্ম সম্পর্কে অজ্ঞতাই তার আজকের এ অবস্থার জন্য দায়ী। নিজেকে তুলে দেবে সে তার স্বামীর হাতে ধরা ‌‘ছেনির’ সামনে। আহসান যেন তাকে ছেনির আঘাতে আঘাতে তার ভিতরের সকল কালিমা ছেঁচে তাকে দুষন মুক্ত করতে পারে। কই আহসানতো তার জন্য পথ রুদ্ধ করে যায়নি বরং তাকে নিয়ে তার সে মহাযাত্রায় সাহায্যকারী হবার আবেদন রেখেছে। সে মা-বাবাকে নিশ্চিন্ত থাকতে বলেছে।

-ওগো! তুমিতো অনেক বড়, অনেক মহৎ। এই যে, আমি হাজির। আমাকে পথ দেখাও, অনন্ত জীবনের কথা শোনাও, তোমার সাথী করে নাও-বেহেস্তের সেই মৃত্যুহীন জীবনের যাত্রী হবার সাধনায় আমাকে উদ্বুদ্ধ কর, সাহায্য কর।

বাবা অফিস থেকে আসার ঘন্টা খাকে পরে নীলা বাবার কাছে গেল। বলল

-কালকের দিনটা আমায় দিতে পারবে বাবা?

-কেন পারব না। বল কি করতে হবে।

মেঝেতে নখের আচড় বসাতে থাকে নীলা

-আমাকে তুমি ওর কাছে দিয়ে আসবে বাবা?

বাবার চোখ দু’টো যেন বড় হয়ে গেল। বললেন

-অবশ্যই যাব। আজ রাতের কোচে যেতে চাইলে তাও পারব।

-না. বাবা। কাল সকালেই রওয়ানা হবো।

পরদিন বিকেলের মধ্যেই শ্বশুর বাড়ীতে গিয়ে হাজির হল নীলা। বাসায় ঢোকার আগে নিজের মনকে সাজিয়ে নেয় নীলা। বাড়ীতে আহসানরা তিন ভাই, কোন বোন নেই তাদের। বাসায় ঢুকেই মা মা বলে ডাক দেয় নীলা। বলে

-এই যে মা, তোমার মেয়ে ফিরে এসেছে।

ডাক শুনে মা বাইরে এসে হতবাক হয়ে যান। যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। প্রথমে মাকে সালাম করে নীলা। বলে

-আপনি কেমন আছেন মা? বাবা কেমন আছেন?

-আমরা ভালই আছি। তোমার শ্বশুর সাহেব দোকানে। তা বেয়াই সাহেব কেমন আছেন? আপনাদের দু’জনকে দেখে আমি খুব খুশী। আরো বেশী খুশী এ এক নতুন বউমাকে পেয়ে যে ক’দিন আগে লুকিয়ে ছিল এ বাসায়।

এবারে কথা বলে নীলা

-বাবাকে কোন রুম দেখিয়ে দেব মা? বাবাকে সেখানে দিয়ে আমি এখনই ফিরে আসব রান্না ঘরে-তোমাকে সাহায্য করতে।

মায়ের চোখে পানি এসে গেছে। এবার মা বলেন

-একটু কাছে আয়তো মা। আয় দু’জনে বলি ‘আলহামদুলিল্লাহ”। উভয়ে আলহামদুলিল্লাহ বলার পর মা বললেন

-আমার খুব কাছে আয়তো মা। আমি তোর মাথায় হাত দিয়ে একটু দোয়া করব। নীলা এগিয়ে গেলে মা তার মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করলেন। এরপর পর হাতটা নিয়ে চুমু খেলেন।

বাসায় তখনও ফেরেনি আহাসন। গোসল সেরে এ জানালার ধারেই বসেছে সে। জানালার গরাদ গলিয়ে বাইরে তাকাতেই চোখে পড়ল বুলবুলি বাসা। বাসাটা পুরো তৈরী হয়ে গেছে। ওরা দু’জনে বাড়ীতে নেই। এইতো ওরা এসে বাসায় বসল।

এখানেই অতীতের স্মৃতি রোমন্থন শেষ করলো নীলা। পাশের কামরায় আহসানের গলা শুনছে নীলা। এইমাত্র ফিরল অফিস থেকে। স্বামীর আবছা চেহারাটা ভেসে ওঠে নীলার চোখে। সামনে এলে সে কি আহসানের বুকে ঝাপিয়ে পড়বে। না, না তা হতে পারে না। সেতো অপবিত্র। আর আহসান উন্নত, পবিত্র। পাপ তাকে সহজে ছোয় না, নির্লজ্জতা তাকে দেখে ভয় পায়। সে অতি শক্তিশালী কেননা সে তার স্রষ্টাকে চিনতে পেরেছে। আর নীলা অন্ধকারে থেকে বেরিয়ে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাড়িয়েছে। শেষ বিচারের দিন আগুনের লেলীহান শিখা ছুটে আসবে তার দিকে। তার শরীরে চামড়া পুড়তে থাকবে, পুড়বে আবার গজাবে। আবার পুড়বে আবার গজাবে অথচ সে দুনিয়ার মত অজ্ঞান হয়ে পড়বে না। ঐতো আগুনের শিখা ধেয়ে আসছে তার দিকে। হ্যা, তার দিকেই আসছে। চিৎকার করে ওঠে নীলা

-না, আমি আগুনে পুড়তে চাই না। আমি বাঁচতে চাই। বিশ্বাস কর আমি বাঁচতে চাই। মৃত্যুহীন জীবন চাই। আগুন তোমরা আমায় ধর না। বিশ্বাস কর আমি বুঝতে পারিনি। আমাকে অন্তত: একটি বার সুযোগ দাও। আমি মানুষের সেই স্বভাবগত জীবন প্রনালীর ধারক আর বাহক হব। আমার সমাজ আমাকে সৌরভের সাথে মিশতে বারণ করেনি, বাধা দেয়নি। আমি কি জন্ম নিয়ে অন্যায় করেছি। সমাজের মানুষ কেন তোমরা আমার এ সর্বনাশ করলে। কিন্তু আগুনতো ছুটে আসা বন্দ করছে না।

-বাঁচাও, বাঁচাও। আরো জোরে চিৎকার করতে থাকে নীলা

এক সময় আবিস্কার করে, সে তার স্বামীর বাহু বন্ধনে আবদ্ধ। ঝট করে নিজেকে আলাদা করে ফেলে নীলা। বলে

-খবরদার আমায় স্পর্শ করবেন না। আপনার এ অপমান আমি সইতে পারব না। দোহাই আমাকে স্পর্শ করবেন না। আমি অপবত্রি। স্পর্শ করে আমায় অপরাধী করবেন না। আমি যে আপনার স্পর্শের অযোগ্যা।

সাথে সাথেই দ্রুত এগিয়ে নীলাকে আবার জোরে আকড়ে ধরে আহসান। বলে

-কিন্তু নীলা সত্যেরে আলোতে স্নাত হয়ে তুমি পবিত্র হবে বলেইতো আমি আশায় বুক বেঁধেছি, পথ চেয়ে বসে আছি

নিজেকে আহসানের কাছ থেকে আবারো ছাড়িয়ে নেয় নীলা। এরপর বিস্ময়কর দৃষ্টি ছুড়ে দেয় আহসানের দিকে

-কিন্তু আমার পক্ষে পবিত্র হওয়া অসম্ভব। সৌরভই এর সাক্ষী।

-আর আমার আল্লাহ এতটাই দয়ালু-মেহেরবান যে, তার দাস যখন ভুল বুঝতে পেরে মাফ চেয়ে তার পথে আসতে চায়, তিনি তাতে খুশী হন। তাকে পুরো পাক সাফ করে তিনি মাফি লালায়িত  দাসের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন।

-সত্যি বলছেন আপনি!

-হ্যা, এটা আমার কথা নয়, এটা আল্লাহর কথা। তবে তুমি শেষ পর্যন্ত কতটা সফল হবে তা নির্ভর করবে তোমার ভবিষ্যত কর্মকান্ড অর্থাৎ ইসলামের জন্য তুমি কতটা নিবেদিত প্রাণ হবে-তার উপর। আমি বিয়ের পর জানতে পেরেছি এক যুবকের কথা। হতে পারে সে এ সমাজের হবার কারণে জানতে পারেনি সে কি জন্য মানুষ,  পৃথিবীতে সে কেন এসেছে।

-সত্যি আপনি সব জানেন। কিন্তু তবুও তা হয় না, তা হয় না। ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলে নীলা। গন্ড বেয়ে নেমে আসে অঝোর ধারা

-আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি তুমি সততা, ন্যায়-নীতির ধারক, সত্যবাদিনি, স্পষ্টবাদী, স্পষ্টবাদী, সুবিচার বজায়ের প্রশ্নে একজন আপোষহীন যুবতি। এমন মানুষ আমাদের সমাজে অতি অল্প। তাই আমার জীবনের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য এ মন-মানসিকতার একজন সাহায্যকারী ও সহযোদ্ধাকে পাশে পাওয়া ছিল আমার আজীবন স্বপ্ন। তাই তোমাকে পাবার লোভ এখন আর সামলাতে পারিনা। অবশ্য আমি সব সময় গভীরভাবে বিশ্বাস করি, ‘ঐশীবাণী সাময়িক না জানার কারণে আল্লাহর পথে পিছিয়ে থাকলেও এ সব মানুষ যখন আল্লাহর বাণীর সংস্পর্শে আসে, তাদের বহুজনই তার সৃষ্টিকর্তাকে চিনতে ভুল করে না। তারা ব্যতিক্রমী ভূমিকা রাখে। ইতিহাস তাদেরকে কাগজের পাতায় সোনালী অক্ষরে ধরে রাখে, অতীতে মক্কা-মদিনার সোনার মানুষদের ধরে রেখেছে। আমাদের পরিবারটা তেমন হবে তা দেখার জন্য আমি ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করছি নীলা।

একটু থামে আহসান। তারপর বলে

-আল্লাহর কাছে দোয়া চেয়েছি অবিরাম এবং বার বারই মন বলেছে ”সত্য যখন তোমার হৃদয়ের বদ্ধ আগল খুলে দেবে তখন তুমি সৌরভের নয় আমার হবে। আর এখন সে ’হওয়ার’ সময় আমার দ্বারপ্রান্তে টোকা দিচ্ছে। আসলে তুমি একা নও, সত্য থেকে নিজেকে বঞ্চিত রেখে তুমি নিজের উপর জুলুম করেছ নীলা। সে জুলুমের এখন অবসান। এখন এক নতুন যাত্রার নতুন জীবনে প্রবেশ করলে তুমি, যে জীবনে তোমার মত হাজারো যুবতি তোমার সাহায্যের মুখাপেক্ষী। তুমি এগিয়ে না এলে কে পালন করবে সে দায়িত্ব? বল তুমিই বল, কে পালন করবে? আর আমার বিশ্বাস সে কাজের জন্য তুমিই উপযুক্ত।

এবারে স্বামীকে কাছে টেনে জোর করে বুকে জড়িয়ে  ধরে নীলা। স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলে

-হ্যা, আপনি আমার পাশে থাকলে আমি অবশ্যই তাদের পাশে দাড়াবো। কিন্তু এলেনই যদি তবে এত দেরী করে এলেন কেন? সৌরভেরও আগে এলেন না কেন?

-না, নীলা! সৌরভ যেভাবে এসেছিল সেভাবে আমি কখনও আসতাম না, আসতে পারি না। এ বিষয়ে আমি আমার আল্লাহর কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এক যুবক। ওভাবে মুসলিমরা আসতে পারে না, ওভাবে আসতে নেই, ওটা সর্বনাশের পথ।

একটু বিরতি নেয় আহসান। এরপর মুজাতের দু’হাত তোলে, সাথে নীলাও যোগ দেয়

-বরং পরে যখন তোমার হয়ে এলাম সেদিন মনে মনে ভেবেছি, এবার জয়ী আমায় হতেই হবে। আল্লাহর মেহেবানীতে আজ আমি জয়ী হয়েছি নীলা। তুমিও পিছিয়ে নেই। তোমাকে আজ অনেক মোবারকবাদ। আলহামদুলিল্লাহ হে রব্বুল আ’লামিন। হে আল্লাহ তুমি আমার প্রতি, নীলার প্রতি অনেক মেহেরবান। আমাদরকে তুমি তোমার দ্বীনের পথে চলতে, ঈমানের দাবী পূরণ করার তৌফিক দাও, এ কাজে বরকত দাও। সব সময় তুমি আমাদের জন্য সাহায্য পাঠাও। আমরা তোমারই জন্য এবং তোমার কাছেই ফিরে যাব।